News Bangla

সময় গেলে সাধন হবে না

নাজনীন সীমন।

যেহেতু মা সেলাইও জানতেন, বলে নেয়া ভালো আমার জীবনের বেশীর ভাগ জামা বোধ হয় মায়ের হাতের বানানো, এমনকি সোয়োটারও, তিনি চাইতেন সেলাই শিখি আমি। বাড়ির সবার সোয়েটার, স্কার্ফ, টুপি ইত্যাদি মা বুনতেন নিজের হাতে। ছোটোবেলায় বন্ধুদের কেনা মেশিনে বোনা সোয়েটার পরতে দেখে মনে হতো ওদেরটা সুন্দর। আজ মনে হয় মায়ের হাতের সেই সব জিনিসের সমতুল্য পৃথিবীতে কিছু নেই। এতোগুলো বছর পেরিয়ে গেলো, তবু আমি তাঁর হাতের একটা জিনিসও ফেলতে পারিনি; কেবলই মনে হয় মায়ের ছোঁয়া লেগে আছে সব কিছুতে। মনে হয়, বলতাম, যদি ফিরে পেতাম তাঁকে, আবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাপ নিয়ে আমাকে জামা বানিয়ে দিতে, শীতের কাপড় বুনে দিতে; প্রচণ্ড শীতে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে। মাঝে মাঝেই শীত করে আমার, মায়ের কথা মনে হলেই গায়ের লোম কেঁপে ওঠে; অথচ কোনো দিন আর মা ফিরে এসে আমাকে উষ্ণতা দেবে না–জানি না কবে এই সত্য এভাবে আর আমূল কাঁপাবে না আমাকে!

নিজের গুণগুলো আমার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার বৃথা চেষ্টা করেছিলেন মা। বহুবার সেলাই মেশিনে বসিয়েছেন এবং প্রতিবারই আমি স্প্রিং এর খেলনার মতো লাফিয়ে উঠে গেছি। এরপর হাল পুরোপুরি ছেড়ে না দিয়ে পাঠালেন সেলাই স্কুলে। ‘কাঠের মানুষ ভণ্ডুল’ এর মতো চব্বিশ ঘণ্টা শক্ত হয়ে থাকা সেই সেলাই দিদিমণি, অবশ্য দিদিমণি বলা যাবে না যেহেতু ওনাকে আমরা কাকী সম্বোধন করতাম একই কলোনীতে থাকার কারণে, কেমন করে যে বাঁশের মতো স্থির থাকতেন, কে জানে! কস্মিনকালেও এই পোড়া চোখে ওনার হাসিমুখ আমার চোখে পড়েনি, এমনকি ঘাড়ও নাড়াতে দেখিনি কোনো দিন। কাকতাড়ুয়া তবু বাতাসে দোলে তার মাথায় বসানো মাটির হাঁড়ি নিয়ে, মুখে কিন্তু তার সাদা রঙের হাসি আঁকা থাকে; কিন্তু মেম্বার কাকী, ওনার অর্ধাঙ্গ কলোনী কমিটির মেম্বার ছিলেন বলে ওনাকে ঐ নামে ডাকতাম আমরা, কোনো অবস্থায় ওনার মাথা নড়তো না। ঘাড় নাড়ানোর বদলে ওনার পুরো শরীর রোবটের মতো ঘুরে যেতো যদি কোনো দিকে তিনি তাকাতে চাইতেন। ফলে ওনার প্রকাশ্য নাম ছিলো ‘মেম্বার কাকী’ আর আড়ালের নাম ছিলো ‘কাকতাড়ুয়া কাকী’। সেই মাত্রার রসকষহীন মানুষটির কাছ থেকে আমি শিখবো সেলাই! তার উপর অঙ্ক জাতীয় কিছু আমার মাথায় ঢোকে না। গ্রাফের খাতায় স্কেল আর পেন্সিল দিয়ে এতো ইঞ্চি হাতা, তার ঘের এতো করে সেই জামা, হাফ প্যান্ট, শার্ট, ব্লাউজ, এক ছাঁট, ছয় ছাঁটের পেটিকোট এঁকে তারপর আবার কাপড়কে ভাঁজ করে মাপ নিয়ে চক দিয়ে দাগ দিয়ে কেটে পা মেশিনে সেলাই করো–অতো হাঙ্গামা আমাকে দিয়ে হবার নয়। অতসব থেকে জ্যামিতির সম্পাদ্য উপপাদ্য আঁকাও বোধ হয় সোজা ছিলো। তবু কাকতাড়ুয়ার মতো সেলাই কাকীর কাছে কিছু দিন গিয়েছিলাম শিখতে: দু’চারটে প্যান্ট, ফতুয়া, শার্ট, জামা, পাজামা ইত্যাদি বানিয়েছিলামও। তখন আমাদের একেবারে ছোটো ভাইটি সবে জন্মেছে। সব বানাতাম ওর জন্য। সে আনন্দটা অন্য রকম। তবে সেলাই স্কুলে যেতাম আমি অন্য একটি কারণে! কারণটা উহ্যই থাক। কিছু দিনের মধ্যে মনে হলো বিকেলে যে সময়টায় আমি খেলা বাদ দিয়ে সেলাই শিখছি, সে সময়টা আমার ভাই কিন্তু ঠিকই খেলছে। ব্যস, বিগড়ে গেলো মাথা অথবা পেয়ে গেলাম অজুহাত। সোজা বিদ্রোহ করে বসলাম শুধু মেয়েদের জন্য সে কাজ, তা আমি শিখবো না। আর পায়ে কে আমাকে! একবার যখন ঘাড় বাঁকা করেছি, সেটা সোজা করে সাধ্য কার? ঘাড়ের রগ বাঁকা পরিবারের মেয়ে আমি। সেই আমার সূচীকর্মের ইতি। এখন মানুষের নানা গুণ দেখি আর ভাবি লালনের সেই অমর বাণী, “সময় গেলে সাধন হবে না”। আসলেই হয় না।

কাকতাড়ুয়া কাকীর আরো একটা নাম ছিলো যেটা প্রকাশ্যেই অনেকে ডাকতো–পুষির মা। বিড়াল পালতেন উনি। ছোটোবেলায় ভাবতাম কেবল বিড়াল রাখেন কিন্তু বাচ্চা নেই কেনো? তখন মানবজীবন চক্র সম্পর্কে আসলেই কিছু জানতাম না বা জানার বয়স হয়নি। আমার ধারণা ছিলো প্রতিটি সংসার হবে বাবা-মা-ভাই-বোন-কাকা-ফুফু নিয়ে। যদি তা নাও হয়, প্রথম চার সম্পর্কের মানুষ থাকতেই হবে। অথচ ‘পুষির মা’ কাকীর ঘরে ছিলো খালি মেম্বার কাকা, কাকী, দুটো পুষি আর তাদের ছানারা। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অংশ হিসাবে ওনার বাসার সামনে যে মাঠ সেখানে একটি স্লাইড আর দোলনা বসানো হলো যাতে ওঠার জন্য আমাদের সে কি উচ্ছ্বাস; রীতিমতো প্রতিযোগিতা লেগে যেতো। রোদ পড়ে স্টিলের স্লাইডটি গরম হয়ে যেতো; তার প্রতি থোড়াই ভ্রুক্ষেপ করে সিঁড়ি বেয়ে প্রায় ফোস্কা-পড়ার মতো গরম স্লাইড দিয়ে নীচে নামতাম সাঁই সাঁই করে; আবার কখনও উল্টো দিক দিয়ে পিচ্ছিল স্লাইডে হেঁটে হেঁটে উঠে আবার নামতাম যতোক্ষণে অন্য একজন সিঁড়ি বেয়ে আসছে। তাতে করে কম সময় লাগতো এবং একবারের বদলে দু’বার স্লাইড দিয়ে নামা যেতো। জীবনে নানা ধরনের রাইডে চড়েছি যার কোনো কোনোটা খুবই ভয়ঙ্কর। যখন অন্ধকার সুড়ঙ্গে নিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উপরে ওঠে আর নীচে নামে, তখন মনে হয় ঠিক ভেজা কাপড় চিপড়ানোর মতো করে আমার শরীর চিপড়িয়ে কেউ ভিতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব একটা একটা করে বের করে আনছে। আবার অনেক উপরে উঠিয়ে যখন মাথা উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখে, তখনও এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে এ যাবত করা সবচেয়ে বেশী উচ্চতা, চারশত ছাপ্পান্ন ফিটের কিংডা কা-তে ওঠার যে আনন্দ, শিহরণ, তার থেকে কোনো অংশে কম ছিলো না এই স্লাইডে ওঠার অভিজ্ঞতা। প্রায়ই সিঁড়ি বেয়ে উঠে আমরা কেউ কেউ গোয়েন্দার মতো খুঁজতে চেষ্টা করতাম আসলে ওনার ঘরে কোনো বাচ্চা লুকিয়ে রেখেছেন কি না। সে সময় ‘তিন গোয়েন্দা’ সবে পড়তে শুরু করেছি। কিন্তু কখনও বাচ্চা তো দূরের কথা, ওনাদের ঘরে কোনো অতিথি পর্যন্ত আমরা যেতে আসতে দেখিনি। সেই বিস্ময় আজও আমার কাটেনি এবং কেনো যেনো মনে হয়, হয়তো ওনার সন্তান জন্ম না দেয়ার কারণেই আত্নীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো। নিঃসন্তান থাকাটা যে কতোটা কষ্টের এবং সে দায় যে কেবল নারীর উপর পড়তো একটা সময়ে যা এখনও অনেকেই বিশ্বাস করে, সে কে না জানে! আমরা কখনোই জানতে পারিনি আসল ঘটনা কি, কার দোষ। কিন্তু যখন থেকে অনেক কিছু বুঝতে শুরু করেছি, ‘পুষির মা’ কাকীর জন্য আমার খুব কষ্ট বোধ হতে থাকে। এক ধরনের অপরাধ বোধ আমাকে ক্লান্ত করে। বারবার ভাবি সেই সময় অতিরিক্ত কৌতূহলে, নির্বুদ্ধিতার কারণে কোনোভাবে এই দুখী মানুষটাকে আঘাত করে ফেলিনি তো! না থাকার, না পাওয়ার কষ্ট কেবল যে সেই ঘটনার মধ্যে দিয়ে যায়, সে-ই বুঝতে পারে, অন্য কেউ নয়।