তোয়াব খান; সম্পাদকদের সম্পাদক। ‘সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান’ বলতে যা বোঝায়, বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে তার শেষ সলতে তিনি। সাংবাদিক হিসেবে সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য কর্মজীবন তার। দেশের সংবাদপত্র জগতের প্রিয়মুখ। ২০১৬ সালে একুশে পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে তাকে। একই বছর বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানিত ফেলো হিসেবে নির্বাচিত করে। অগ্রজপ্রতিম সাংবাদিক হিসেবে দেশের সব সংবাদকর্মীর মনে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনটিও তো জাতীয় প্রেস ক্লাবের এই আজীবন সদস্যেরই।
নির্মোহ-নির্লোভ মানুষ তোয়াব খানের নামটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র যে মানুষটির চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তাকে একবার দেখে ভেতরের মানুষটিকে বিশ্নেষণ করা সম্ভব নয়। আপাত গাম্ভীর্যের আড়ালে যে সংবেদনশীল মানুষটির বাস, তাকে আবিস্কার করা সহজ নয়। এর জন্য সময় ও শ্রম দিতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তোয়াব খান নিজে কয়জনের কাছে উন্মোচিত করেছেন নিজেকে? গুরুগম্ভীর তোয়াব খানের আড়ালে যে স্নেহময় মানুষটি লুকিয়ে আছে, তাকে কি তিনি প্রকাশ করেছেন সবার সামনে? তবে আপাতগম্ভীর এই মানুষটির সাহচর্য যারা পেয়েছেন, তারা জানেন, ওই গাম্ভীর্যের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে খুব বেশি সময় লাগে না। আর সে কারণেই বলা যেতে পারে একজন তোয়াব খানকে আবিস্কারই করতে হয়। এই আবিস্কারের আরেকটি গূঢ় কারণ হচ্ছে, তার জীবন তো কোনো মামুলি জীবন নয়; চলমান এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনকালে শুরু যে পথের, তা আজও বহমান। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরির্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এ জন্যই তিনি সমসাময়িক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে ‘তোয়াব খান’ নামটি উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধায়।
ইতিহাসের সাক্ষী তিনি। সেই কবে থেকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখছেন সময়ের বয়ে চলা ও পরিবর্তন। জন্ম ব্রিটিশ ভারতে। এরপর পাকিস্তানি শাসন পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ। সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেছেন। দেখেছেন একাত্তর। ধারণ করে চলেছেন একাত্তরের চেতনা। অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে, একজন বিপ্লবী কলমসৈনিক হিসেবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত হতো তার ‘পিণ্ডির প্রলাপ’। তার জীবনকে কোনো মামুলি জীবন বলা চলে না। ইতিহাসের সাক্ষী হতে হতে তিনি আজ নিজেই তো এক ইতিহাস। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরির্তন আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে নানা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এক মানুষ তিনি। তার জীবনখাতার পাতাগুলোও তো কম বর্ণিল নয়। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে তিনি এক উজ্জ্বল তারকা। সাংবাদিকদের সাংবাদিক তিনি- তাতে সন্দেহ কী! পেশাগত জীবনে সাড়ে ছয় দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসে আজ তিনি নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। সবসময়ে সমসময়ের প্রতিনিধি। একজন যথার্থ আধুনিক মানুষ তিনি। সেই আধুনিকতার প্রতিফলন তার পেশা ও ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পরতে।
জনপ্রিয় শিল্পী নচিকেতার গানে আছে, ‘অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন/শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন’। নয় দশক ছুঁই ছুঁই মুখর জীবনে সংবাদমাধ্যমের মহিরুহপ্রতিম এই মানুষটির পথচলাও যেন অন্তবিহীন। ব্যক্তিজীবনে যেমন স্মার্ট আর স্টাইলিশ তিনি; তার লেখনীও তেমন নির্মেদ আর তীক্ষষ্ট। যদিও পাঠক হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, তিনি লিখেছেন কম, লিখিয়েছেন বেশি। তিনি এক অসাধারণ গল্পকথক। অনুপুঙ্খ বলে যান আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। দীর্ঘ সময়ের প্রতিটি ঘটনা তার নখদর্পণে। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগ নেই। তার চেতনায় একাত্তর, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। সাংবাদিক হিসেবে তিনি পরিবর্তনগুলো যেমন দেখেছেন, তেমনি সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবেও দেখেছেন খুব কাছ থেকে। খুব কাছে থেকে স্বাধীনতার মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছেন। ১৯৭৩-৭৫-এ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুই বেছে নিয়েছিলেন তাকে। ছিলেন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রেস সচিবও। ১৯৮০-৮৭ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। পালন করেছেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্বও।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার সাতক্ষীরার রসুলপুরে। পড়েছেন সাতক্ষীরার সার্ধশত বছরেরও বেশি পুরোনো পিএন (প্রাণনাথ) স্কুলে। স্কুলের পাট চুকিয়ে ঢাকায় কলেজে পড়তে আসা। বছর না ঘুরতেই ভাষা আন্দোলনে উত্তাল দেশ। ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় হলেন। এরপর থেকেই ভেতরে ভেতরে একটা পরিবর্তনের হাওয়া। অজান্তে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দীক্ষা। বদলে যায় জীবনের গতিপথও। পেয়ে বসে বিপ্লবের নেশা। ১৯৫৩ সালে কেজি মুস্তাফার সঙ্গে বের করেন সাপ্তাহিক জনতা। এর মধ্য দিয়েই হাতেখড়িও তার সাংবাদিকতা জীবনের। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন সংবাদে। ১৯৬১ সালে সংবাদের বার্তা সম্পাদক। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে, বার্তা সম্পাদক হিসেবে। ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। সত্যবাক নামে দৈনিক বাংলায় শুরু করেন ‘সত্যমিথ্যা, মিথ্যাসত্য’ শিরোনামে বিশেষ কলাম। এ কলামে উঠে আসে একটি স্বাধীন দেশের আর্থসামাজিক চিত্র। অনস্বীকার্য বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একেকটি মাইলফলক রচিত হয়েছে তারই নেতৃত্বে। প্রথম চাররঙা সংবাদপত্র এর মধ্যে একটি। ‘সবসময়েই পাঠকরাই আমার প্রাইমারি কনসার্ন- এ কথা সবসময় বলেন তিনি। তার একমাত্র বই ‘আজ এবং ফিরে দেখা কাল’।
অগ্রসর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সাংবাদিকতাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন তিনি। সাংবাদিকতা এক সৃজনশীল পেশা। সেই সৃজনযজ্ঞে ব্রতচারীর ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। বহুদর্শী মানুষটি যশ-খ্যাতির পেছনে ছোটেননি কখনও। অদ্ভুত আড়ালচারিতা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে লড়াই এখনও চলছে, এই লড়াইয়ে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তোয়াব খান। আজ তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন, তোয়াব ভাই। আপনার স্নেহছায়ায় আরও অনেকটা পথ হাঁটতে চায় সংবাদমাধ্যম কর্মীরা।
অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]