নাজনীন সীমন। কবি ও লেখক।
বুঝিয়ে দেয়ার, ভালোবাসার মানুষেরা সবার জীবনে আসলে থাকে না চিরকাল এবং যার থাকে না, সে-ই পলে পলে টের পায় এর জ্বালা কতোখানি। জীবনে প্রথম মৃত্যু নামক ডাকপিয়নের খোঁজ পাই বোধ করি সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে এর সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ছাড়াই। তার উপস্থিতিতেই যে সব বুঝে গিয়েছিলাম, তাও নয়। বরঞ্চ বলা ভালো, কিছুই টের পাইনি এটুকু ছাড়া যে মৃত্যু হলে মানুষ কাঁদে, খুব কাঁদে। সম্ভবত বাবার অফিসের ফোনে ফোন এসেছিলো এবং সেই সময়ে তিনি চট্টগ্রাম-যশোর তিনখানা বিমানের টিকিট কেটে মা ও আমাকে নিয়ে পৌঁছেছিলেন মায়ের বাড়ি। আমার স্পষ্ট মনে আছে বিমান বাংলাদেশের বলাকা প্রতীক দেয়া প্লাস্টিকের গ্লাস আর ন্যাপকিন আমি ব্যবহার না করে জমিয়ে রেখেছিলাম নানাকে দেবো বলে। নানা কি আমার খুব প্রিয় ছিলেন? নিশ্চয়ই ছিলেন। খুব আদর করতেন আমাকে? অবশ্যই করতেন। কিন্তু তার কিছুই আমার মনে নেই। নানার স্মৃতি বলতে আমার কেবল মনে পড়ে উঠোনে শীতের দিনে চেয়ারে বসে তিনি চা খাচ্ছেন যদিও মামা খালা কয়েকজনের কাছেই শুনেছি আমি ভুল; এমন কোনো দৃশ্য তাদের চোখে কখনও ধরা পড়েনি এবং তাদের কথা আমি নির্দ্বিধায় মানি। কিন্তু আমার স্মৃতিতে এই ছবি কোথা থেকে জমা হলো, কেনো হলো, কিভাবে হলো, কিছুই জানা নেই। আজও ভেবে দেখি নানা বাড়িতে তাঁর শোবার ঘরে ঝোলানো ছবির মুখের সাথে আমার স্মৃতির মুখের কোনো তফাৎ নেই। তাহলে কি এটা চেতন অবচেতনের কোনো খেলা? তবে নানা সম্পর্কে আমার সমস্ত জানাই শুনে জানা। ঘটনাগুলো বিশ্বাস হয় দুটো কারণে–প্রথমত কেবল বাড়ির লোক অর্থাৎ মা মামা খালাদের কাছ থেকেই শোনা নয় এসব ঘটনা, বরং গ্রামের লোকজনের মুখেও তাদের ধলা কাকা বা ধলা দাদীর গুণকীর্তন শুনতে পেয়েছি এবং দ্বিতীয়ত ওনার সন্তানদের বেশীর ভাগের মাঝেই এই বৈশিষ্ট্যসমূহ খুঁজে পেয়েছি। নানা নাকি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা দিয়ে আসতেন বিনামূল্যে তো বটেই, বহু বহুবার তিনি নিজের ভাঁড়ার ঘর থেকে চালের শেষ দানাটাও নাকি মানুষকে দিয়ে আসতেন। আবার, তিনি খেতে বসেছেন আর এমন সময়ে কোনো ভিক্ষুক এসে দাঁড়িয়েছে–নিজে না খেয়ে পুরো খাবার ক্ষুধার্ত মানুষটিকে দিয়ে দিতেন। এমনও সময় গেছে যখন মাটির হাঁড়িতে নানীর জন্য পড়ে থাকা ভাত দিয়েই কোনো দ্বিধা ছাড়াই ক্ষুধার্ত আগন্তুকের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করেছেন এবং আমার নানী না খেয়ে রাতের রান্নার জন্য অপেক্ষা করেছেন। তখন তো আর ফ্রিজের চল ছিলো না গ্রামে গঞ্জে; হয়তো নামও কেউ শোনেনি বা এ জাতীয় কোনো জিনিস থাকতে পারে, কল্পনায়ও আসেনি কারো। আর গ্রামে তো সাধারণত যখন তখন চুলো জ্বলে না, বাড়তি রান্নাও হয় না।
নিঃস্বার্থ দানের এ ব্যাপারটি ছাড়াও নানা নাকি যেমন সৎ তেমন ধার্মিক ছিলেন। আমার মেজ মামা তখন সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। বলা হয়ে থাকে এখানে ঢোকা কঠিন, কিন্তু বেরিয়ে আসা আরও বেশী কঠিন। তো মামার মন টিকছে না কোনো মতেই। উনি বাড়ি চলে এলেন নানার শরীর খারাপের কথা বলে। এলেই কি আর হলো! ঠিক ঠিক তদন্ত করতে বাড়িতে লোক আসলো। মামা নানাকে খুব করে বোঝালেন যে কেউ এলে যেনো বলে উনি চোখে দেখেন না, মামাই ওনার অন্ধের যষ্ঠি ইত্যাদি যা যা জানানো ও বোঝানো দরকার। চোখে দেখতে কতোটুকু সমস্যা হয় জিজ্ঞেস করতেই নানা, আমার মামার বাপজান খুব জোর গলায় বললেন এ জাতীয় কোনো সমস্যাই তাঁর নেই বরং তিনি দিব্যি বহু দূরে দেখে বলতে পারেন কর হাঁটছে, কে যাচ্ছে এসব। নিশ্চিত আরও অনেক কথা ছিলো, তবে আমার এটুকুই মনে আছে। ফলতঃ নানার সততার কারণে শাস্তি না দিয়েই মামাকে চাকরীতে যোগ দিতে বাধ্য করেছিলো তদন্তকারী অফিসার। তাঁর ধার্মিক সত্তার কথা বলতে হলে সেই বহু প্রচলিত কথাই উচ্চারণ করতে হয় যা কিনা কে কতোটা চরিত্রবান, বোঝাতে ব্যবহৃত হয় একমাত্র চারিত্রিক সনদ হিসেবে–জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজও ক্বাজা করেননি যদিও জানি না আমি ধর্ম পালন করা বা ধার্মিক হওয়া কোন প্রকারে মানুষের মনুষত্বের মাপকাঠি হতে পারে এবং কেনোই বা সেটা হয়। অতীত হোক, নিকট অতীত হোক আর বর্তমানই হোক একটু খেয়াল করলেই কি ইমাম, পূজারী, পাদ্রী প্রমুখের নানা ধরনের অপকর্মের কথা কানে বাজে না? অথচ তাঁরা তো স্ব স্ব ঈশ্বরের ঘরে নিমগ্ন থাকেন প্রভূর সন্তুষ্টি আদায়ের জন্য দিনরাত এবং মেনে চলেন সমস্ত নিয়মকানুন, মুখস্ত বলে দিতে পারেন ধর্মীয় বিধান। সাথে সাথে ধার্মিকতা যদি ভালো মানুষের পরিচয় হয়, তবে তো পৃথিবীতে নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা, ক্ষুধা, অভাব, হত্যা, ধর্ষণ, মিথ্যা ইত্যাদি সব কর্পূরের মতো মিলিয়ে যাবার কথা বা প্রায় না থাকারই কথা। কিন্তু না! সভ্যতার বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে বরং অমানবিকতা বেড়ে চলেছে, হেন কাজ নেই যা মানুষ করছে না এবং তারপর আবার প্রার্থনালয়ে হামলে পড়ছে, পবিত্র জল ঢকঢক করে গিলছে অথবা ছিটাচ্ছে চতুর্পাশে। তাহলে ধর্ম পালন কেনো ভালো মানুষের মাপকাঠি, বুঝতে পারি না।
সে যাই হোক, সম্ভবত আমাকে নিয়ে মা বেড়াতে গেছেন তাঁর বাড়ি। তাঁর বাড়ি বলার চেয়ে বলা ভালো বাবার বাড়ি, সম্ভবত কেননা মেয়েদের নিজের বাড়ি কোনটি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি আমি। বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি তার বাড়িবদল হয়, সেখানে টিকতে না পারলে আবার বাবার বাড়ি, বাবা বেঁচে না থাকলে ভাইয়ের বাড়ি, সেখান থেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিংবা দোষের বোঝা ঘাড়ে দিয়ে আবার শ্বশুর বাড়ি কিংবা স্বামীর বাড়ি এবং শেষ বয়সে স্বামী কিছু না রেখে গেলে ছেলের বাড়ি–ছোট্টবেলার সেই সাদা কিংবা গোলাপী পিংপং বলের মতো বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো এবং সস্তা হলে অল্পতেই যেমন ফেটে যেতো বলটি, ঠিক তেমনি নারীজন্মও কুমড়োপটাশ হয়ে মাঝপথেই থমকে যেতে পারে বাড়ির মালিকদের উপর নির্ভর করে। এবং স্বামীর বাড়ি বা শ্বশুর বাড়ি তার নিজের বাড়ি নয় বলেই রাগ হলে, ঝগড়া হলে মেয়েরা রওনা দেয় বাপের বাড়ি অথবা ঘাড় ধরে স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির লোকে তাকে বের করে দেয় বাড়ি থেকে এবং তারপর আবার কিছুদিন বাদে ফিরে আসে যাবার মতো আর কোনো বাড়ি তার নেই বলেই। অথচ ৫৭৫০৬০৫৫.৪৯৩৩ বর্গমা্ইল স্থলভূমি রয়েছে পৃথিবীতে। তার কোথাও যাবার মতো জায়গা নেই তার একার। বাঘ, সিংহ নয় ক্ষুধার্ত হায়েনা রয়েছে যারা একাকী দেখলেই খুবলে খাবে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, করবে পৈশাচিক উচ্ছ্বাস। ভূমণ্ডলের এক ছিটেফোঁটাও তার জন্য নিরাপদ নয়; বাবা-শ্বশুর-স্বামী-ছেলের বাড়ি করতে করতে তার জীবন সায়ংকালে পৌঁছায়; নিরুপায় হয়ে সে আত্নস্থ করে নেয় যখন যেখানে আছে সেটাকেই নিজের বলে ভাবতে, নিজের বলে পরিচয় দিতে। কতো চমৎকার মিথ্যের মধ্যে তার বসবাস, কল্পনাও করা যায় না! এবং তার নিজের কিছু নেই বলেই বাড়ি কখনও দাদীর বাড়ি, নানির বাড়ি, মামী-চাচীর বাড়ি হয় না। তার নিজের নয় বলেই মেয়েজামাইয়ের বাড়িতে কতো দিন থাকা যাবে, আদৌ থাকা যাবে কিনা এ নিয়ে নানাবিধ সংস্কার রয়েছে। পৈতৃক ভিটা হয়, মাতৃক ভিটা বলে কিছু নেই। তার্কিকরা হয়তো বলে থাকবেন গোটা দেশটাই তো মাতৃভূমি জ্ঞান করি আমরা। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভূত ব্যাপার হলো গোটা মাতৃভূমিতে কোনো মেয়ের নিজের ভূমি নেই।
ঠিক তেমনি আমার মায়ের পৈতৃক ভিটাতে আমাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছেন তিনি। আমি বোধ হয় তখন সবে হাঁটা শুরু করেছি। ঐ বয়সেই খালি পায়ে আমি নাকি কিছু মাড়াতাম না ধূলো লেগে যাবার ভয়ে। নামাজ শেষে নানা ফুঁ দিতেন নিয়মিত। এটা পরে মাকেও করতে দেখেছি–নামাজ শেষে সবার মাথায়, বুকে ফুঁ দিয়ে দেয়া। নানীর সাথে মা ছিলেন রান্নাঘরে; নানা দরজায় দাঁড়িয়ে আমার খোঁজ করায় মা জানালেন শোবার ঘরে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছেন। প্রতিউত্তরে নানার কথা শুনে মায়ের তো আত্না শুকিয়ে শুকনো নারকেল পাতার দশা। এক ছুটে যে ঘরে শুইয়ে রেখে গিয়েছিলেন, গিয়ে দেখেন সত্যি বিছানা খালি, দুই পাশের কোলবালিশ এতোটুকুও না নড়ে অনুগত সৈন্যের মতো পাহারা দিচ্ছে যেনো গড়িয়ে না পড়ে কৃষ্ণবরণ কন্যাটি। সব ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। পুকুর ও খালপাড় দেখা হলো। উঠোন, পাশের মাঠ, অন্যান্য মামা ও পড়শীদের বাড়ি বাদ গেলো না কিছুই। নেই তো নেই। সবাই যখন খোঁজাখুঁজিতে এবং কার কি মনে হচ্ছে কোথায় যেতে পারি এ বিষয়ে আর এরপর পুকুরে লোক নামাতে হবে, কে নামবে এসব আলোচনায় ব্যস্ত, মা তখন আবার ঘরে এসে আবিষ্কার করলেন আমি নিজ থেকে কোথাও যাইনি কেননা আমি স্যান্ডেল জুতো ছাড়া মাটিতে পা ফেলি না একেবারেই।
আবার খোঁজ খোঁজ খোঁজ–কেউ হয়তো কোলে করে নিয়ে গেছে। তখন এখনকার মতো অসভ্য হয়তো ছিলো না মানুষ কিংবা এই পরিমাণ লম্পট ও নৃশংস হয়ে পারেনি অথবা হলেও সে সংখ্যা এতোটাই হয়তো কম ছিলো যে মানুষের কান অবধি পৌঁছে তাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলতে পারেনি। আর গ্রামে তো ছেলেধরার প্রশ্নই ওঠে না। ফলে সবাই আবার সবার ঘরবার করে না পেয়ে পুকুর আর খালে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে আর অন্য এক দল চলে গেছে বাড়ির সাথে লাগোয়া জঙ্গলে। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে পাওয়া গেলো বিশাল বড়ো এক গাছের নীচে মাটিতে শোয়া অবস্থায়। আকাশ ছুঁতে চাওয়ার স্পর্ধা দেখানো গাছের ছড়ানো পাতার ফাঁক ফোকর গলে যুবক রোদ্দুর খাড়া হয়ে মুখে পড়ছিলো আমার, কালো মুখটা তেতে ঘেমে উঠেছিলো। হৈ হৈ করে নিয়ে এসে বারান্দায় রাখা হলো এবং তারপর পড়া পানির বন্যা বয়ে গেলো শরীরের উপর দিয়ে। আর যে পরিমাণ ফুঁ দিয়েছিলো সবাই, একত্রিত ভাবে এলে হয়তো লু হাওয়াই তৈরী হতো। সব কিছুর পর জ্ঞান ফিরে এলো এবং আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হলো কিভাবে গেলাম, কার সাথে গেলাম, কেনো গেলাম, কখন গেলাম, কি হয়েছিলো–এসব হাজারটা প্রশ্ন প্রত্যেকে অন্তত হাজার বার করে করেছে। কিন্তু ঐ অতোটুকুন আমার কি আর সেসব মনে ছিলো কিছু। তার চেয়ে বড়ো কথা আমি কি আর জেনেবুঝে গিয়েছি! কোনো উত্তর না পেয়ে হুজুর ডাকা হলো এবং তিনি নিদান দিলেন, এ আর কিছু নয়, জ্বিনে ধরেছিলো। অল্পের জন্য বেঁচে গেছি আমি; আর মাত্র কিছুক্ষণ বাদেই আমাকে নিয়ে রওনা হতো জ্বিনের রাজ্যে। এ কথায় বিশ্বাস রাখতে কারো বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ হয়নি।