News Bangla

প্রবল ইচ্ছে মুখ থুবড়ে পড়ে মাতাপিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের নীচে

প্রবল ইচ্ছে আমার মুখ থুবড়ে পড়ে মাতাপিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য – নাজনীন সীমন

হয়তো মায়ের নিজের ভিতর প্রচণ্ড কষ্ট ছিলো কলেজ যেতে পারেননি বলে। হয়তো তাই আমাদের লেখাপড়াকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন তিনি। সাথে সাথে তিনি চাইতেন তার ছেলেমেয়ে সর্বগুণে গুণান্বিত হোক সাধ্যমতো এবং সব পরিস্থিতিতে যেনো তারা মানিয়ে নিতে পারে। তাই মোটামুটি শিল্প সাহিত্যের নানা শাখায় আমাদের উঁকি মারার সুযোগ করে দিতে কার্পণ্য করেননি কখনও। কিন্তু গান বাজনা আমাদের বোধ হয় চৌদ্দ নারী-পুরুষের জিনের মধ্যে নেই; ফলত সুরলক্ষী কণ্ঠে এসে বসত গাঁড়েনি। যেই গুরুর কাছে গিয়েছি, তিনিই বলেছেন সাধনা করলে বিশাল বড়ো শিল্পী হতে পারবো; কণ্ঠে না কি আমার সেই গুণ আছে। কিন্তু কথায় বলে না, “আলস্য দোষের মূল আঁকর”! দু’চার দিন মহা উৎসাহে আ আ করার পর আবার যা তাই–হারমোনিয়াম ঢাকা পড়ে থাকে দিনের পর দিন, উপরে গানের খাতা নিয়ে। ‘নতুন কুঁড়ি”-তে নতুন নতুন প্রতিভা দেখি, নতুন করে উদ্দীপনা পাই, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি ‘গান আমি শিখবোই’। দু’দিন পরই আবার সেই থোর বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়। আমার ভাইকেও গান শিখতে দেয়া হলো। হলো না কিছু। তারপর তবলা শিখতে দেয়া হলো। আমার তখন সাধ জাগলো তবলা শিখবো। এবং মা না করেননি। মনে আছে যুগল কাকা, আমাদের পারিবারিক বন্ধু-কাকা, শেখাতেন তবলা আমাদের। কিন্তু যা হবার তাই হলো আবার। আমার সেই শুকনো পাটকাঠি হাতে অতো জোর ছিলো না–একটুতেই হাঁপিয়ে উঠতাম। বেশ কিছু দিন এই গান আর তবলার মধ্য দিয়ে চলতে লাগলো। না হলো কোনো উন্নতি, না ভাসলাম সুরে।

এরপর শখ জাগলো গীটার বাজানোর। যুগল কাকার বাসায় যেতাম আমরা দুই ভাই বোন এবং স্নেহের বশে কাকা ওনার বাদ্যযন্ত্রটি হাতে তুলে দিতেন আমাদের, পালা করে। কিন্তু ঐ যে সুরের কোনো নামগন্ধ আমরা এক্স বা ওয়াই ক্রোমোজোম থেকে পাইনি বলেই হয়তো বেসুরো রয়ে গেলাম আজীবন। তবে শিল্পের যা করতে মন চাইতো আমার, তা কখনও করতে দেয়নি আমাকে পরিবার থেকে। অভিনয় আমার ভীষণ ভালো লাগতো। সুচিত্রা, সুবর্ণা–এঁরা ছিলেন আমার ধ্যান। তার চেয়েও বড়ো ব্যাপার ছিলো সুচিত্রা- উত্তম আর সুবর্ণা-ফরিদী–কেবল মনে হতো এঁদের মতো কিংবদন্তী জুটি হয়ে উঠবো। কতো রকম হয় মানুষের স্বপ্ন! হয়তো বাড়ির ধারে কাছে অভিনয় শেখার তেমন কোনো সুযোগ থাকলে মা দিতেন, কিন্তু বাবা রাজী হতেন না আমি নিশ্চিত। ফলে ঐ ছোটখাটো অনুষ্ঠানে এক আধটু অভিনয়ের মতো করা ছাড়া আর তেমন কিছু সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। স্কুলের রজত জয়ন্তীতে বিশাল অনুষ্ঠান হলো; সেখানে আমার “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ আবৃত্তির সাথে নেচেছিলো আমার বন্ধু টগর। আবৃত্তির কথা জানি না, তবে তার নৃত্য পরিবেশন ছিলো অপূর্ব এবং পুরো হল ভরে গিয়েছিলো করতালিতে যদিও আমি জানি না দর্শক চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ছাপিয়ে নৃত্যকলা আদতে কতোটুকু উপভোগ করতে পেরেছে। অনুষ্ঠান শেষ হবার কিছু দিন বাদে বাবা আর মায়ের কথা কানে ভেসে এসেছিলো: চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের হয়তো কোন অনুষ্ঠান প্রযোজক বা পরিচালক সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি চেয়েছিলেন আমাকে রেডিওতে শিল্পীর তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করতে। বাবা সরাসরি না করে দিয়েছিলেন পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে। বড়োদের কথা শোনার বা না ডাকলে তাঁদের কথা বলার সময় সেখানে বসে থাকার কোনো অনুমতি আমাদের ছিলো না বলে সে আলোচনায় ঢুকে আমার মত প্রকাশ করতে পারিনি, পরেও বলতে পারিনি আমি ওটাই করতে চাই কেননা তাতে আমি জানলাম কিভাবে জাতীয় এক হাজার একটা প্রশ্নের উত্তর করতে হতো এবং অনুমতির বদলে ন্যায় অন্যায়ের অদৃশ্য দাঁড়িপাল্লা দিয়ে আমি ঠিক কাজ করেছি কি না তা নির্ধারণ করতে হতো আমাকেই। ফলে অভিনয় জগতে ঢোকার প্রবল ইচ্ছে আমার মুখ থুবড়ে পড়ে মাতাপিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য জাতীয় রচনার মূল বক্তব্যের নীচে।

আবার মায়ের ইচ্ছে ছিলো রান্নাটা শিখে নেই। কিন্তু কাঁচা মাছ মাংশ ধরার কথা মনে হলেই আমার গা গুলিয়ে আসতো; রাঁধবো কেমন করে! অথচ আমার ভাই কিন্তু বেশ বানাতো এটা সেটা, টুকটাক–বয়স তো তখন খুব কম; আর এখন তো সে কিছু রান্না করলে চেটেপুটে খেতেই হয় সকলকে যদিও ঘি তেল মশলার শ্রাদ্ধ ঘটে পুর্ণ মাত্রায় তাতে। তবে আমার রান্নার শখ ছিলো বেশ উদ্ভট। বাবা নিয়ে গেলেন একবার বাজারে সম্ভবত দাদীর মৃত্যুদিবসে কেনাকাটা করার জন্য। আমাদের ঘরে নিয়ম করে দাদা, দাদী ও নানার মৃত্যুবার্ষিকীতে গরীবদের খাওয়ানো এবং মসজিদে মিলাদ দেয়ার ব্যবস্থা হতো; নানী তখনও জীবিত। সব কেনাকাটা শেষে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বাবা জিলিপি ভাজিয়ে আনলেন। গরম গরম সেই জিলিপির স্বাদ যেনো এখনও ভুলিনি! স্বাদের চেয়েও বড়ো কথা, অতো মহৎ শিল্প যেনো আমি কখনও দেখিনি; কেমন হাত ঘুরিয়ে প্যাঁচ দিয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা টগবগে তেলে, লাল হয়ে উঠলেই সিরার ভিতর, আর তারপর সেখান থেকে উঠিয়ে প্যাকেটে। এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে জিলিপি বানানোর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিলাম। সেই সময়ে তো ইউটিউব ছিলো না যে ধাপে ধাপে দেখবো আর বানাবো! জিলিপিওয়ালাকে যেভাবে দেখেছিলাম, ঠিক সেভাবে করতে চাইলাম। এমনকি মায়ের মাটির চুলো ছিলো একটা শীতের দিনে চিতই পিঠা বানানোর জন্য। সেটা নামানো হলো, সিরা করে রাখলাম বিশাল গামলায় কেননা শুধু নিজে খেলে তো হবে না; বিল্ডিংয়ের সবাইকে দিতে হবে তো! এবার পালা জিলাপি ভাজার। গোলা নিয়ে যতোই প্যাঁচ দিতে যাই ততোই ফেটানো ডিমের মতো পড়ে ছড়িয়ে পড়ে যেনো চারপাশটা গিলে খাবে। আর ভাজা হলে উঠিয়ে সিরায় দিতেই সেটা যেনো আবার আটার দলায় পরিণত হয়, তবে কাঁচা নয় ভাজা ময়দা। কিন্তু দমে গেলো তো চলবে না। বহু কিছু দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। লাভের লাভ আগুন, ময়দা, চিনি আর তেল নষ্ট। কোনোটা হলো ছোটো ডালপুরি, কোনোটা বড়ো, কোনোটা রুটির মাপের, কোনোটা কোনো পর্যায়ে পড়ার মতো না। আমাদের গর্ব চিত্রা পাড়ের এস এম সুলতান চোখে দেখলে হয়তো এর নাম দিতেন জিলিপির বিমূর্তকরণ!

কিন্তু মা এতোটাই বেরসিক যে তেল চিনি আর ময়দা ধ্বংস ছাড়া কিচ্ছু দেখলেন না এতে! টেবিলে আসতে আসতে সেই অদ্ভুত জিলিপি যে কেমন কিম্ভূতকিমাকার হয়ে উঠলো, সে ভুলতে পারবো না জীবনে। তবে হ্যাঁ, কষ্ট করে চোখ বন্ধ রেখে মুখের ভিতর পুরে দিতে পারলে স্বাদ কিন্তু নেহায়েত খারাপ ছিলো না! কেবল আজও তাকে দেয়ার মতো নাম খুঁজে পাইনি। সেই বারো তেরো বছর বয়সে ঐ একবারই, তারপর আর কোনো দিন, কখনও ঐ পথ ভুলেও মাড়াইনি। বারবার তো আর বিমূর্তকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে জিলিপিতে বসানো যায় না। এমনকি এই করোনা কালে যখন বাংলার ঘরে ঘরে, বিশেষত বিদেশে বসবাসরত বাঙালীদের পরিবারগুলোতে জিলিপির প্যাঁচের প্রতিযোগিতা চলেছে, তখনও যাইনি ঐ পথে আর। মাপে মাপে যেসব জিনিস করতে হয়, বরাবরই তাতে আমার ভয় ও বিতৃষ্ণা খুব। জীবন তো সম্পাদ্য বা উপপাদ্য বা পীথাগোরাস কি ফার্মার থিওরি নয়, নিউটন বা আইনস্টাইনের তত্ত্বও নয় যে অতো নিয়ম মেনে চলতে হবে! হয়তো এটা কাজ এড়ানোর জন্য আমার অজুহাত মাত্র। দেশী, মোগলাই, চায়নীজ রান্না থেকে শুরু করে বেকিং করতেন মা; বড়ো জোর উঁকি দিয়ে দেখতাম কখনও সখনও কিন্তু নিজে করার আগ্রহ হয়নি। শ্বশুর বাড়ির ভয় দেখাতেন মা। আর বাবা তখন প্রশ্রয় দিয়ে বলতেন সারা জীবন ধরে তো করতেই হবে, এখন না করলেও চলবে। এইসব সময়ে বাবাকে মনে হতো দেবদূত।