ফজজুল বারী।। ‘নথি চোর’ কথাটা শুনলে হাসি পায়। সাংবাদিক মাত্র এটা নিয়ে হাসবেন। কারন চুরি ছাড়া বিস্ফোরক রিপোর্টের খুব কম বিশ্বে হয়েছে। আর এই নথি চুরির সিংহভাগ করে সংশ্লিষ্ট দফতরের লোকজন। এরজন্য বৃটিশ আমলে রাজ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য অফিসিয়েল গোপনীয়তার আইনটি করা হয়েছিল। বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইনটি ব্যবহার করা হয়েছে। বংশ পরষ্পরায় আওয়ামী লীগের লোকজনকে এই বদনামটি শুনে যেতে হবে।
উন্নত বিশ্বে মিডিয়ায় মিলিয়ন ডলার বাজেট থাকে সোর্সের জন্য। এরজন্য সংশ্লিষ্ট দফতরের সোর্সরা এসব নথির ফটোকপি বা স্ক্যান-ছবি তোলা কপি চুরি করে। বাংলাদেশের প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের মতো পত্রিকার সোর্স মানির সংগতি আছে। পত্রিকা দুটি নানান বাহিনীর সোর্সদের জন্যেও নানান অংকের ব্যয় করে। অন্যরাতো ঠিকমতো বেতনই দিতে পারেনা, সোর্স মানি কিভাবে ম্যানেজ করবে।
মিডিয়ায় যারা নথি দেন তারা মূলত সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রতিপক্ষ। একজন আরেকজনকে সাইজ করতে নথি দেন। দরপত্র না পাওয়া লোকজনও নথি দেন সাংবাদিকদের। আরেক গ্রুপ আছে যারা নির্মোহ ভাবেই নথি দেন বিশ্বস্ত সাংবাদিককে। তারা পাঠক হিসাবে চান এটা মিডিয়ায় যাক। দেশের মানুষ জানুক। আবার সরকার থেকেও নথি, ফোনালাপের অডিও এসব দেয়া হয়।
ফোনালাপের অডিও ফাঁস এটা এই সরকারের আমলে বেড়েছে। বিএনপি আমলের লোকজনের মাথায় অত ঘিলুও ছিলোনা। অথবা এসব প্রযুক্তি তখনও ছিলোনা বাংলাদেশের হাতে। শুধু রাজনীতিক না, নানান বাহিনীর লোকজন। এমনকি সাংবাদিকদের ফোনেও এখন আড়িপাতা হয়। বিদেশ থেকে ফোন করলে বলেন, ভাই হোয়াটসআপে আসেন।
হেফাজতের শাপলা চত্বরের তান্ডবের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির খালেদা জিয়াকে ফোন করে সংলাপের আহবান জানান। এর অডিও ভিডিও একাত্তর টিভি সহ আরও কয়েকটি চ্যানেলকে দেয়া হয়। নতুবা এটা কারো পক্ষে পাওয়া সম্ভব ছিলোনা।
খালেদা জিয়ার আমলে রাজনৈতিক সংকটের সময় সাদা পোশাকের লোকজন দিয়েও মিডিয়ায় খবর করানো হতো। তেমন লোকজন আমাদের ফোন করে বলতেন ভাই ‘দেখেনতো সুধাসদনে অমুক গেছেন কিনা। আমারে একটু জানাইয়েন’। প্রথম দিকে মনে করতাম আমাকে বুঝি এক্সক্লুসিভ দেয়া হয়েছে। পরে দেখা গেলো এমন ফোন অনেকে পেয়েছেন।
আমি একসময় চট্টগ্রামের পূর্বকোনের ঢাকা ব্যুরো চীফ ছিলাম। তখন বিভিন্ন পত্রিকার সচিবালয় বিটের লোকজন আমাকে চট্টগ্রাম বিষয়ক নানান নথি দিতেন। অথবা তাদের সোর্স তাদের মাধ্যম এটা আমাকে পাঠাতেন, তারা চাইতেন নিউজটা চট্টগ্রামের পত্রিকায় ছাপা হোক। অফিসে বসে বসে এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট করতে ভালোই লাগতো।
এখন বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় বড় সংকটের নাম নিজস্ব সেন্সরশীপ। রিপোর্টার এক্সক্লুসিভ নিউজ পেয়েছেন। কিন্তু তা ছাপা হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। কারন মালিকদের নানান ব্যবসা আছে। সরকার মনোক্ষুন্ন হবে এমন রিপোর্ট ছাপার ঝুঁকি তারা নেননা। এসব নিয়ে কত রিপোর্টার মানসিক অশান্তিতে ভোগেন। এ নিয়ে অনেক রিপোর্টার সংশ্লিষ্ট পত্রিকা মিডিয়া ছেড়েও দেন। নতুন একটি মিডিয়া যখন আসে তখন দেখে কোন মিডিয়ার কোন রিপোর্টারের সোর্স ভালো। যত টাকা হোক তারা তাকে ভাগিয়ে নিতে চান।
যে রিপোর্টারের সোর্স ভালো তার রিপোর্ট পড়তে দেখতে চান, পাঠক-দর্শক। নথি চুরি বা চুরিকৃত নথি না পেয়ে কোন রিপোর্টার বড় রিপোর্টার হননা। আদালতেরও নথি চুরি বিক্রি হয়। এরসংগে আদালতের কর্মচারী আইনজীবীরা জড়িত। কোন কোন ক্ষেত্রে বিচারকও যে জড়িত না এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেনা।