সহন ক্ষমতা ও রাগের একটি ঘটনা এখনও চোখে ভাসে পরিষ্কার। মনে হয় এই তো ঘটছে আমার সামনে। শীতকাল চলছে। আমরা তখন দুই ভাইবোন; ছোটো ভাইটির বয়স বছর দেড়েক। থাকি বহুতলা সরকারী কলোনীর চারতলা বিল্ডিংয়ের দুই তলায়; আর আমাদের ঠিক উপরেই থাকে চার সদস্যের এক পরিবার–শিশু সন্তানটি আমার ভাইয়ের বয়সী; চতুর্থ সদস্যটি বাড়ির কাজে সাহায্যকারী একটি মেয়ে,বয়স হয়তো তেরো কি চৌদ্দ। ভদ্রলোক, আমরা কাকা বলে ডাকতাম, কাস্টমসে কাজ করতেন এবং তাঁর স্ত্রী যাঁকে ‘ফুটবল কাকী’ (গোপন নাম) ডাকতাম যাঁর গাত্রবর্ণ ছিলো ধবধবে ফর্সা। তিনি ছিলেন বেশ বেঁটে ও গোলগাল মুখের অধিকারী। দৈর্ঘ্য প্রস্থে প্রায় সমান বলেই বোধ করি এই নাম দিয়েছিলাম। হয়তো গাত্রবর্ণের কারণে তিনি অহঙ্কারী ছিলেন বেশ। তার চেয়ে বড়ো কথা বেশ অ-সভ্য প্রকৃতির ছিলেন। বিল্ডিংয়ের কারো সাথে তো তিনি মিশতেনই না, বহুবার ভিক্ষুকদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে এটা সেটা বলতে শুনেছি এবং প্রায়ই শুনেছি গৃহকর্মীর কান্না। যেহেতু কারো সাথে তাঁর ওঠাবসা ছিলো না, হয়তো সে কারণেই কেউ কখনও জিজ্ঞেস করতে পারেনি মেয়েটি অমন কাঁদে কেনো। সব মিলিয়ে ধারণা করি তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে একেবারেই অশিক্ষিত ছিলেন এবং সামাজিকতাজ্ঞানশূন্য ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন কোনো ব্যাপার না হলেও মানুষের উপর কিছু প্রভাব পড়ে এর কারণে। তখন সব স্বাভাবিক মনে হলেও এখন চিন্তা করি, হয়তো অমন সুন্দর গায়ের রং এর জন্যই কৈশোরত্তীর্ণ হতে না হতেই তাঁর বিয়ে হয়েছিলো এক সরকারী চাকুরের সাথে। ওনার পোষাকেও মানে শাড়ি নির্বাচন ও পরার ধরনেও অনাধুনিকতার ছাপ ছিলো অন্তত সেই সময়ে আধুনিক ও রুচিসম্মত বলে আমরা যা জেনেছি, যদিও আধুনিকতা ব্যাপারটাই গোলমেলে।
ছোটো বেলায় ফুফু ও খালাকে যেমন পাজামা পরতে দেখতাম, ওটাই সবচে’ আধুনিক মনে হতো। অথচ ফ্রক ছেড়ে পাজামা ধরতে ধরতে ঐ হাঁটুর দিকে চাপা আর পায়ের পাতার দিকে প্রায় হাতখানেক ছড়ানো ধরনগুলো পুরনো হয়ে গেলো, এলো নতুন ছাঁট। সেই থেকে কতো যে কাট ছাঁট এলো আর গেলো! কোনো একটায় অভ্যস্ত হতে না হতেই নতুন কিছু বাজারে এবং ফ্যাশন সচেতন আমার আত্নীয় বন্ধুরা সাদরে গ্রহণ করতো সে পরিবর্তন। ঘুরতে ঘুরতে সেই ছড়ানো পাজামা কিঞ্চিত পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগিয়ে এলো ডিভাইডার নামে–তখন বোধ হয় আমি দ্বাদশ শ্রেণীতে। ঘুরে ঘুরে চোজ পাজামা আরো পরিবর্তিত হয়ে এলো চুড়িদার নামে, ডিভাইডার হয়ে গেলো প্লাজো, এলো প্যান্টকাট পাজামা। সত্যি বলতে কি এতো নামধাম আমি কোনো দিনই শিখে উঠতে পারিনি আর নতুন বলেই কিছুকে গ্রহণ করতে হবে তেমনটা কখনোই মনে হয়নি। সবচেয়ে বড়ো কথা, সামান্য এদিক ওদিক পরিবর্তন করে পুরনো জিনিসই ঘুরে ফিরে আসে বলে আমি মনে করি। আজ যেটা সবচেয়ে হালের পোষাক বলে পরিচিত, কিছু দিন বাদে সেটিই হয়ে যায় পুরনো এবং বেশ অনেকটা সময়ের ব্যবধানে আবার ফিরে আসে। পোষাকের আধুনিকতা তবে কি? আমার পোষাক যিনি তৈরী করে দেন এখন, যাঁকে আমি জ্বালাই যখন তখন কাপড় দিয়ে এবং দুই একদিনের মধ্যে ফেরত চেয়ে এবং যিনি সব কাজ ফেলে রেখে হলেও আমারটা করে দেন যথাসম্ভব দ্রুত সময়ে, সেই কমলদা প্রতিবার নতুন নতুন কাটছাঁট দেখিয়ে আমার পুরনোতেই থেকে যাওয়ায় ক্লান্ত হয়ে বোধ হয় সবচেয়ে সঠিক কথাটি বলেছিলেন আমার সম্পর্কে, “আপারে নিয়া চিন্তা নাই। সবাই পরতাছে নতুন সব জিনিস আর আপা পুরানাতেই আছে”।
প্রতিবার দেশে গিয়ে এই নতুন নতুন ধরনের সাথে খাপ খাওয়াতে সত্যি আমি পারিনি। কিন্তু তারও চেয়ে বড়ো কথা, আধুনিক নামে যা চালানো হচ্ছে তা সাদামাটাভাবে ‘পুনর্ব্যবহার’ বা ‘রিসাইক্যাল’ বই কিছু মনে হয় না আমার এবং এটি যে পুরোপুরি আমার চিন্তা তা নয়; মায়ের মুখেই প্রথম শুনি এমন কথা। আধুনিক ফ্যাশনের রোজ রোজ পাল্টে যাওয়ার সাথে তাল মেলানোতে আজও আমি অনভ্যস্ত। পোষাক ও আধুনিকতা নিয়ে আমার কিছু প্রশ্নও রয়েছে। নারীদের পোষাকে এই যে এতো শত ঘুলঘুলি, বারান্দা ইত্যাদি ইত্যাদি কার মাথা থেকে আসছে এসব? আমি ঢাকায় প্রথমে যে দোকান থেকে কাপড় তৈরী করাতাম, প্রায় বছর চারেক পর সেখানে গিয়ে দেখি এখন আর তৈরী করা জামা পাজামা, ব্লাউজ ঝুলছে না। ঝুলছে না মানে একটিও না। তার জায়গায় বিভিন্ন ধরনের, যথাসম্ভব বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশের হরেক রকম কাজ করা বোরখা ঝুলছে। ভদ্রলোক নিজেই মালিক এবং হেড টেইলরিং মাস্টার ছিলেন এবং কৈশোরোত্তীর্ণ হবার দাগ ছোঁবার বেশ কিছু আগ থেকেই ওনাকে চিনি বিধায় চাচা ডাকতাম। চাচার চেহারায়ও ব্যাপক পরিবর্তন। সুঠাম শরীর, সুদর্শন চেহারার উপর ঝুলছে পরিপাটি করে কাটাছাঁটা আগাছা নিংড়ানো শ্মশ্রু। দেখতে বেশ লাগছিলো। ওনার কাছে জামার ডিজাইনের ক্যাটলগ চাইলে জানালেন মেয়েদের ইসলামী পোষাক ছাড়া আর কিছু তিনি করেন না। পাকিস্তানী কাবুলী পরা চাচাকে তৎক্ষণাত জিজ্ঞেস করলাম মাপ কে নেয়? তিনি বললেন, আগের মতোই এখনও তিনিই দোকান সামলান; সেলাইয়ের কাজ কর্মচারী করেন। দ্বিচারিতা কি একেই বলে? আপাদমস্তক পুরুষের ‘লোলুপ’ নজর থেকে রক্ষা করে পুরুষজাতিকে স্খলনের যে মহান দায়িত্ব নারীর উপর দেয়া হয়েছে, সেই কর্তব্যভার পালন করতে গিয়ে শরীরের মাপ পরপুরুষকে দিয়ে নেয়ানো কি এই ‘মহৎ’ উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক নয়? অপর দিকে যাদের চরিত্র সহজেই দূষিত হতে পারে নারীর ঠোঁট, চোখ, নাক, অঙ্গুলি, বক্ষদেশ, পশ্চাৎদেশ, এমনকি মাথার চুল দেখেও সেই পুরুষের নারীর কটি, বক্ষ ইত্যাদি মাপা কি স্ববিরোধিতা নয়? তেঁতুল তত্ত্বের জনকের আবির্ভাব থেকে এ সময় ঢের দূরের গল্প হলেও দৃঢ় বিশ্বাস করি, ধীরে ধীরে ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার যে আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশে, সাম্প্রদায়িকতার যে নগ্ননৃত্য দেখতে পাই, ধর্মব্যবসার এই যে ফুঁসে ফুলে ওঠা–এক দিনে তো সম্ভব নয়; এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো বেশ আগে থেকে এবং আমরা আজ দেখছি এক বিষবৃক্ষ। ভাষার আগ্রাসন, পোষাকের আগ্রাসন ধীরতিধীরে এমন ভাবে জেঁকে বসেছে আমাদের উপর যে বোধের শিকড় নড়বড়ে হয়ে গেছে।
উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া বদরাগ এবং জেদ দুটো সঙ্গী করে প্রতিদিনের নানা রঙের মুখোশ পরা মানুষের সান্নিধ্যের অভিজ্ঞতা নিয়ে হয়তো এ আমি অন্য কোনো মানুষ। হয়তো প্রত্যেকেই এমনটা বদলে যায় সময়ের কর্কশ আঘাতে। যে কথা না বললেই নয়, এই ‘ফুটবল কাকী’ যতো দূর মনে পড়ে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়েছিলেন এবং তাঁর খাওয়াদাওয়া, ডাক্তারের কাছে নেয়া সব মা নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন। সুস্থ হবার পর তিনি মাকে বোন সম্বোধন করতেন এবং তদানুযায়ী আচরণও ছিলো তাঁর। আজ এটা, কাল সেটা বাটি চালাচালি চলতো দু’ঘরে এবং ক্রমে ‘ফুটবল কাকী’ নাম দেয়ার জন্য লজ্জা পেতে শুরু করলাম যার ফল স্বরূপ আস্তে আস্তে টিকটিকির লেজের মতো নীরবে খসে পড়লো ‘ফুটবল’। যখন কাকার বদলির কারণে ঐ ছোট্ট সরকারী বাসা ছেড়ে যাচ্ছিলেন, মনে আছে, ট্রেন স্টেশনে যাবার জন্য রিক্সায় ওঠার আগে মাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! মানুষ বড়ো বিচিত্র এক প্রাণী! কোথায় যে কখন কিভাবে তার বন্ধন তৈরী হয় আবার কখন তা কিভাবে ছিন্ন হয় বোঝা মুশকিল।
সাম্প্রদায়িকতার এই চরম উল্লম্ফন বন্ধ করতে যথাযোগ্য শাস্তি প্রয়োজন