News Bangla

জ্বিনের বসবাসের নানা কাহিনী

নাজনীন সীমন।।
তাছাড়া আমার নানাবাড়িতে জ্বিনের বসবাসের নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। যেমন একবার নানী রাতে রান্নাঘরের কাজ শেষ করে ঘরে এসে নানাকে বললেন ওনার সাথে যেতে; উনি পানি আনবেন পুকুর থেকে। নানা অসম্মতি জানালে নানী একাই যান এবং পেছন ফিরে দেখেন সাথে সাথে নানা আসছেন। পানি নিয়ে রান্নাঘরে রেখে ঘরে ফিরতেই দেখেন নানা বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। তখন না ডেকে সকালে জিজ্ঞেস করলেন ঐ অতোটুকু সময়ের মধ্যে এমন সাড়হীন ঘুমালেন কি করে, নানা তো আকাশ থেকে পড়লেন রীতিমত। না, তিনি তো কোথাও যাননি। কারও বুঝতে বাকী রইলো না নানীর সাথে একটা ভালো জ্বিন গিয়েছিলো যাতে তাঁর কোনো ক্ষতি না হয়।

আবার একাধিক বার নাকি রান্না করে নানী বা নানীর জায়েরা পুকুরে ডুব দিয়ে ফিরে এসে খাবার দিতে গিয়ে দেখেন কোনো হাঁড়ি, কড়াই কিচ্ছু নেই রান্নাঘরে। তারপর “বাবারা, ছেলেমেয়েগুলো না খেয়ে থাকবে, খাবারগুলো দিয়ে যাও” ইত্যাদি বলার পর নাকি আচমকা হাঁড়ি চলে আসতো জায়গায়। আবার কেউ একজন অবিশ্বাস করে বলেছিলো কলকাতার রসগোল্লা গরম গরম খাওয়াতে পারলে বিশ্বাস করবে জ্বিন আছে, তাদের ক্ষমতাও আছে। গ্রাম ভর্তি লোকের সামনে নাকি গাছ থেকে গরম রসগোল্লার হাঁড়ি পড়েছিলো একটার পর একটা। এমন অজস্র আজগুবি গল্প মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছি বারবার যেনো মুখস্ত করে পরীক্ষার জন্য বসতে হবে।

এই জ্বিনদের মধ্যে সবচেয়ে রাগী ছিলো রবিউল বাদশা। তার চলার পথে কেউ পড়লে নাকি খবর ছিলো। আবার বাড়ির সাথে লাগোয়া নয়, পাঁচ সাত মিনিট হয়তো হেঁটে গেলে অন্য একটি পুকুরে একসময় নাকি অনেক পানি ছিলো। আমি বরাবরই ওটিকে প্রায় মজা হিসেবেই দেখেছি। কেউই সচরাচর ওটি ব্যবহার করতো না। তবে এর পাড়ে দাঁড়ানো টক বরই গাছটির বরইয়ের স্বাদ ছিলো অতুলনীয় যদিও প্রায়শই তাতে পোকা মিলতো। এর কোনো ঘাট বা নামার সিঁড়ি ছিলো বলেও মনে পড়ে না। কতো কতো গল্প শুনেছি, গ্রামের কারো বাড়িতে বিয়ে, আকিকা, মুসলমানী হলে হাঁড়ি-পাতিল, চামচ, বাসন সব ঐ পুকুর থেকে ভেসে উঠতো। নিয়ম ছিলো অবশ্য তার। অজু করে শুদ্ধ মনে গিয়ে চাইতে হতো এবং ভোরবেলা পুকুরে ভেসে উঠতো সব কিছু। তারপর অনুষ্ঠান মিটে গেলে আবার সব ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হতো।

কোনো উত্তর পাইনি যদি মুসলমানদের বদলে হিন্দুদের কিছু দরকার হতো, তাদের কি কি করতে হতো। একবার একজন জিনিস নিয়ে লোভ সংবরণ করতে না পেরে একটি কাঁসার চামচ লুকিয়ে রেখেছিলো বাড়িতে; বাকী সব জিনিস ফেরত দিয়েছিলো। সেই দিন ঐ পুকুরে প্রচণ্ড ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি হয়েছিলো, চারপাশ প্রকম্পিত করে শব্দ উঠেছিলো যা শুনে সকলেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। তারপর ঐ পাকের মধ্যে থালাবাসন, হাঁড়ি পাতিল সব মিলিয়ে গিয়েছিলো এবং এরপর আর কখনও সেখানে চেয়ে কিছু পাওয়া যায়নি। এমনি আরো কতো শতো সহস্র গল্প যে আছে, ইয়ত্তা নেই।

এসব কি হ্যালুসিনেশন না অন্য কিছু জানা নেই। একটা গ্রামের সমস্ত মানুষ কেমন করে হ্যালুসিনেশনে ভোগে? আবার নানী যে মিথ্যে বলবেন, আমি তা কোনো অবস্থাতেই মানতে পারি না। তবে একটাই সান্ত্বনা যে নানীর নিজের মুখ থেকে এ ঘটনা শুনিনি আমি। ফলত মনে হয়, মুখে মুখে সাদামাটা কোনো ঘটনার বর্ণনা হয়ে গেছে জ্বিনের কাহিনী; একই ভাবে অন্যান্য গল্পগুলোও লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে অলৌকিক সব ঘটনার খাতায় নাম লিখিয়েছে; বাঁশঝাড়ের লম্বা বাঁশ পূর্ণিমার চাঁদের নীচে হয়ে গেছে রবিউল বাদশার লম্বা শরীর।

কিন্তু আমি যেটা এখনও বুঝতে পারি না, আমি তাহলে ওখানে গেলাম কেমন করে! সেদিন যদি এই আমি থাকতাম, নিঃসন্দেহে প্রশ্ন করতাম জ্বিনের কোনো সমস্যা আছে কিনা। এতো মানুষ থাকতে এই কালো শিশুকে তার নিজের রাজ্যে নেয়ার দরকার কি? সে কি তবে নিঃসন্তান ছিলো? নাকি নপুংসক ছিলো? স্ত্রী জ্বিনের কাছে মানসম্মান রাখতেই হয়তো একটি মানবশিশুকে নিয়ে যাবার পায়তারা করছিলো। নাকি তার নিজের বাচ্চার খেলার সাথী দরকার ছিলো? জ্বিনেরা তো আর মানুষের রক্ত খায় না যে কচি বাচ্চার রক্ত দরকার ছিলো। কিন্তু না আমার তখন এসব কিছু বোঝার বয়স ছিলো, আর না পরে সুযোগ পেয়েছি কাউকে জিজ্ঞেস করার। বেড়ে উঠেছি তো জ্বিন-ভূত-প্রেতের হাজারটা ভয়ের গল্প নিয়ে। সন্দেহ যখন দানা বাঁধলো, তখন যেতে যেতে মানুষগুলো সব হারিয়ে গেলো সময়ের মধ্যে পুকুরের ঐ ঘূর্ণির মাঝে যেমন করে থালাবাসনগুলো চিরদিনের জন্য। এখনও যখন ভাবি কোনো হিসাব পাই না; মনে হয় দুটো জিনিসের একটি ঘটে থাকতে পারে–প্রথমটি হলো অজানা কোনো পারিবারিক শত্রু রেখে এসেছিলো এই ভেবে যে শিয়াল বা বেজী কিছু একটা ধরে নিয়ে যাবে নিশ্চয়ই। আর দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি হলো ঘুমের মধ্যে হেঁটে আমি নিজেই গিয়েছিলাম সেখানে। যদি প্রথমটি হয়, আমার এখনও খুব জানতে ইচ্ছে হয় কে সেই মানুষটি, কেনো এটি করতে চেয়েছিলো সেই ব্যক্তি। এই শোনা ঘটনাগুলোই সত্যমিথ্যের বাদবিচার না করে আমার জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিলো। যতো বার গিয়েছি ঐ বাড়িতে, রাতে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম, একলা বেরোবার তো প্রশ্নই আসে না। হারিকেন তো সাথে থাকতোই, বালিশের নীচে ম্যাচবাক্স রেখে দিতাম, এক টুকরো লোহাও থাকতো সাথে। আর দোয়া দরূদ তো বলাই বাহুল্য! কিন্তু কস্মিনকালেও রবিউল বাদশা বা তার পুত্র কন্যা পুত্রবধু জামাতা নাতি নাতনী কারো আভাস পর্যন্ত পাইনি। এখন প্রশ্ন করতে জানি, কিন্তু ভয়ের জায়গায় ভয়টা রয়েই গেছে। রাতের বেলা ঠিকই মগজে গেঁথে দেয়া কল্পকাহিনীগুলো হানা দেয়। এই মগজধোলাইয়ের মাধ্যমেই তো ব্যক্তিকে, সমাজকে, গোটা দেশ ও জাতিকে অন্য কেউ পরাভূত করতে পারে দাস করে রাখতে পারে, রাখে দিনের পর দিন এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দী।

মৃত্যু দেখার কথায় কতো গল্পই না উঠে এলো! আমার মাকে জানানো হয়েছিলো, মানে বাবা জানিয়েছিলেন নানা খুব অসুস্থ। বিমান কখন যশোরের মাটি ছোঁয় আমার মনে নেই। জীবনে প্রথম বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা আমার কেমন ছিলো, ভয় পেয়েছিলো কিনা না কেবল মেঘের সাথে খেলা করেছিলো, কাঁচের জানালার ভিতর দিয়ে হাত গলিয়ে পেঁজা পেঁজা মেঘ ধরতে চেয়েছিলো ছোট্ট মেয়েটি–কিছুই মনে নেই তার। কেবল এর পরের অংশটুকু আবার খানিকটা মনে আছে। আমরা যখন গ্রামে পৌঁছাই, তখন জমাট শীতের ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তার ওপাশ থেকে বাড়ির দিকে আসতে হলে খাল পেরোতে হতো। সেটা ছিলো আর এক ভয়ঙ্কর এবং আনন্দের অভিজ্ঞতা। খালটা নেহায়েত ছোটো ছিলো না; বাঁশের সাঁকো দিয়ে পার হতে হতো। আঞ্চলিক ভাষায় আমরা ওটাকে চার বলে জেনেছি। ঐ চার পার হবার আগেই কেউ একজন মায়ের নাম ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন সব শেষ বলে। ঐ জায়গাতেই মা ‘বাপজান’ বলে চিৎকার করে বসে পড়লেন। এরপর কে কে ধরে মাকে বাড়ির উঠোন পর্যন্ত এনেছিলো, আর মা উঠোনে বসেই কাঁদতে লাগলেন, কাঁদতে লাগলো আত্নীয় স্বজনেরা সব। ঐ প্রথম, জীবনে সেই প্রথম মৃত্যুর গন্ধ কেমন করে আর সব গন্ধ ছাপিয়ে যায়, নিথর দেহ কেমন করে রক্ত চলাচলা করা আর সব মানুষগুলোকে একত্রিত করে, অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। ঘন অন্ধকারে কলতলায় বরই গাছের নীচে মা, তাঁকে ঘিরে আর সবাই যাঁরা শোকের নদীতে দীর্ঘক্ষণ ডুবে আছেন, শীতের উত্তুরে বাতাসে হারিকেনের সলতের কেঁপে কেঁপে ওঠা মাঝে মাঝে, খানিক দূরে নতুন করে সবে সবে উপুড় করে দেয়া মাটির