মিলি সুলতারা।। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতের আকাশবাণীতে বক্তব্য দিয়েছেন পাকিস্তানি নরপিশাচদের বিরুদ্ধে। কাঁদতে কাঁদতে বিদেশিদের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য। তিনি বলেছিলেন পাকিস্তানিদের হাতে নির্বিচারে বাঙালি খুন হচ্ছিলো, নারীরা ধর্ষিত হচ্ছিলো। কবরীর মত এমন দুঃসাহসিকতা ফিল্ম জগতের কেউই দেখাতে পারেননি। লিজেন্ড কবরীর অসামান্য অবদানের কথা অনেকেই জানেনা। কেউ কেউ এমনও বলেছে, কবরীকে কেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হল? তিনি এমন কি করে ফেলেছেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য?? ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে কবরী অসামান্য ভুমিকা রেখেছেন ভারতে অবস্থান করে। পাক হানাদার বাহিনীর ভয়ে কবরী দেশ ছাড়েন। শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় পেয়েছেন ভারতে। যখন আকাশবাণী রেডিওতে কবরীর বক্তব্য প্রচার হত, তখন সিনেমা জগতের অন্যান্য ব্যক্তিরা যারা মনেপ্রাণে চেয়েছেন বাংলাদেশ পাকিস্তানীদের হাতে থাকুক। তারমধ্যে আজকের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা ও তাঁর বোন সুচন্দাও ছিলেন। যুদ্ধের সময় শবনম ববিতা সুচন্দারা পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন। তখন এসব অভিনেত্রীরা বিউটি পার্লারে বসে বসে মেকআপ নিতেন আর কবরী সম্পর্কে নেগেটিভ আলাপচারিতায় ব্যস্ত থাকতেন। “কবরী পাকিস্তানিদের বিপক্ষে বক্তব্য দিয়ে তাদের রোষানলে পড়ছে। সে (কবরী) কি পাকিস্তানে ফিরে আসবেনা? কতদিন থাকবে ভারতে?” এভাবেই “কবরী চর্চায়” মুখর থাকতেন তৎকালীন অভিনেত্রীরা।
“মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন কবরী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন ববিতা।” — এ এক অদ্ভুত সমীকরণ। কবরীর অনেকগুলো ইন্টারভিউ দেখলাম। এক একটা ইন্টারভিউ ছিল ৪৫/৫০ মিনিট হতে শুরু করে ঘন্টাব্যাপী। সবগুলো দেখলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আমার বেশি ভালো লেগেছে আউট স্পোকেন কবরীকে। কথাবার্তা সরাসরি –কোনো ঘুরানো পেঁচানো নয়। ৭১ সালে সুচন্দা ববিতা শবনমরা কোনোদিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি কথাও বলেননি। বরং পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করেছেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর ফায়দা নিতে ভুল করেননি।
অসামান্য দেশপ্রেমের কারণে লিজেন্ড কবরী ওপার বাংলার জৌলুসময় জীবনযাপন ছেড়ে স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন। আর নায়িকা অঞ্জু ঘোষ নিজের স্বার্থ চরিতার্থের জন্য নিজের দেশ ছেড়ে ওপার বাংলায় গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছেন। কিন্তু শেষমেশ হলো টা কি?? এখন জিরো হয়েছেন। ফ্রাস্ট্রেটেড জীবন যাপন করছেন। চলচ্চিত্র থেকে ছিটকে পড়েছেন। স্টেজে যাত্রাপালা করে বেড়াতে হয়েছে অঞ্জুকে। সবাই জানেন অঞ্জু নেশাখোর। একদিন দেখলাম টালমাটাল অঞ্জু ঘোষ স্টেজে উঠে ধড়াম করে ফ্লোরে পড়ে গেছিলেন। দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে অঞ্জু জিরো হয়েছেন। কিংবদন্তি কবরী ভারত ছেড়ে দেশে ফিরে সম্মানিত হয়েছেন। সম্মানের সাথে বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়ে গেছেন।
কবরীকে ভারতে স্থানী হবার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। মহানায়ক উত্তম কুমার কবরীকে বলেছেন, “কবরী দেবী আমি আপনার সাথে একটা ছবি করতে চাই।” সত্যজিৎ রায় প্রচন্ড আগ্রহী ছিলেন। তিনি কথাও দিয়েছিলেন, কবরীকে নিয়েই তিনি কাজ করবেন। কিন্তু অশনি সংকেতে কবরীর পরিবর্তে ববিতার অ্যান্ট্রি হয়েছিল। কবরীর ভাষায়, তাকে বাদ দেয়ার পিছনে শক্ত হাতের পলিটিক্স কাজ করেছে। তবে সরাসরি না বলে আকারে ইঙ্গিতে কবরী সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। ভারতে তাঁকে একটা ফ্ল্যাট দেয়া হয়েছিল থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু দেশপ্রেমের হাতছানি উপেক্ষা করতে পারেননি এই লিজেন্ড। ফ্ল্যাট এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ছেড়ে তিনি দেশে ফিরে এসেছেন। সাইনবোর্ডের মাধ্যমে দেশপ্রেম দেখাতে হয়না। দেশপ্রেমের ফুলকি এমনিতেই বেরিয়ে আসে। যেটা কবরীর বেলায় হয়েছিলো। তিনি একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাই গার্ড অব অনারটাও তিনি ডিজার্ভ করেছেন এবং পেয়েছেনও।