‘
মোঃ নজরুল ইসলাম, শিক্ষক ও সাংবাদিক। মনিরামপুর,যশোর। (লেখাটি অনেক আগের তাই কিছু কালগত ব্যকরণ থাকতে পারে সময় পেলে এডিট করে দিব) ধন্যবাদ।
“এই ভয়ঙ্কর সুন্দর পৃথিবী, বাংলার চির অপরূপ শোভা, রূপসী রাত, সোনালী দিন, এই গ্রাম এই সব মানুষ আমি আর দেখবোনা, আমার হৃদপিণ্ডের শিরা, উপশিরা চর্বির পলি জমে বাংলাদেশের ২৭০টি নদ-নদীর মত মরণ দশা শুরু হয়েছে। ক্ষীণ-শ্রোতা রক্তবাহী নালী গুলি বন্ধ হলেই আমার মরণযাত্রা। শুনব না আযান ধ্বনী নিত্য ভোরে। আচমকা পথ ভুলে বাইবনা জীবণ তরী হৃদয় কূলে কূলে। গাইবনা শব্দ বাক্য গান – বেহায়া এই মন কে শূণ্যে উড়াল দিয়ে এই খানে আর আসব না।” – কথা গুলি লেখা আছে লেখকের অযাচিত বইয়ের মোড়কের উপর । লেখকের এই কথা গুলোর মধ্যে এক জন মানুষের জীবণের শেষ আশ্রয়স্থলে চির প্রস্থানের ইঙ্গিত বহন করে। বহন করে এক চিরন্তন সত্যের ধারা যার কোন দিন কোন কালে ঘটেনি ব্যাত্যয়।
ক্ষণিকের এই পৃথিবীতে আমরা অতিথি মাত্র। সবাই কে একদিন এই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চের অভিনয় শেষে চির প্রস্থান করতে হবে। যাক সে কথা, আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীর পেশায় একজন ডাক্তার। যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ বাজারের পূর্ব-দক্ষিনে মোবারাক পুর গ্রামে তার জন্ম। পিতা মরহুম মৌলভী কেরামত আলী গাজী, মাতা মরহুমা আইমানী বিবি। পিতা সামান্য লেখাপড়া জানলেও মা আইমানী বিবি ছিলেন নিরক্ষর গৃহিনী। তার পরও লেখাপড়ার প্রতি তাদের ছিল সীমাহীন ঝোঁক। প্রচন্ড শিক্ষানুরাগী হওয়ার কারনে সন্তান দের লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীরের পথ চলার সেই সাথী আজ আর তার সাথে নেই। একবুক বেদনা নিয়ে চিরবিদায় হয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। যে সহধর্মীনীর উৎসাহ এবং অনুপ্রেরনায়
তিনি প্রতিষ্ঠিত তাকে হারিয়ে তিনি চিলেন বিপর্যস্ত। আবশ্য তার লেখা বইয়ের অধিকাংশই উৎসর্গ করেছেন তার প্রিয় সেই হতভাগা মানুষটি নাসিমা খানমকে।
চার ভাই এক বোনের মধ্যে আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীল ছিলেন সবার ছোট। বড় ভাই মোঃ রজব আলী অবসর প্রাপ্ত ইউনিয়ন উপ-সহকারী ভূমি কর্মকতা, মেঝ ভাই মোঃ মোজাহার আলী যশোর সন্মিলনী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক। সেঝ ভাই মোঃ আব্দুল বারী রাজগঞ্জ বাজারের এক সময়কার নামকরা ব্যাবসায়ী। এবং এক মাত্র বোন মোছাঃ আনোয়ারা খাতুন কৃষ্ণবাটী গ্রামের মকছেদ আলী গাজীর সহধর্মিনী, একজন গৃহিনী। ১৯৫৭ সালে তার জন্ম। আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীর স্থানীয় রাজগঞ্জ বহুমুখী বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে এস, এস, সি এবং ১৯৭৫ সালে যশোর সরকারী এম, এম, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচ, এস সি পাশ করেন। এবং মেডিকেলে রাষ্ট্রীয় ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করে কর্মজীবন শুরু করেন। তারপর আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীর তার চিকিৎসা পেশায়ও অর্জন করেছেন খ্যাতি। সুনাম ও কুড়িয়েছেন সমান তালে।
তিনি কেশবপুর উপজেলার সাতবড়িয়া ইউনিয়নের স্বাস্থ ও পরিবার কল্যান কেন্দ্রে উপ-সহ- কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। প্রায় ৫বছর হতে চল্ল সরকারি নিয়ম অনুযায়ী চাকুরী থেকে অবসর গ্রহন করেছেন। নিজ কমর্স্থল এলাকায় এত বেশী জনপ্রিয় ছিলেন যে চাকুরী জীবণের প্রায় সারাটি সময় তিনি সাতবাড়িয়া স্বাস্থ কেন্দ্রের সাথে কাটিয়েছেন। একবার তাকে বদলী করা হয়েছিল তখন এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-বণীতা এক যোগে আন্দোলন করে এবং সরকারের উপর মহলে দেনদরবার করে মাত্র কয়েক মাসের মাথায় তাকে আবার ফিরিয়ে এনেছিল। জনপ্রিয় এই ডক্তারের অভাব এখনও চরম ভাবে উপলব্ধি করে ইউনিয়নের মানুষ।
অজ পাড়াগায়ে জন্ম গ্রহন করেও তিনি সাহিত্য চর্চায় ছিলেন অতিমাত্রায় ব্রত। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৭। তার উল্লেখ যোগ্য গ্রন্থ হল, ১। চলার পথে, ২। মৃত্যুর সমুদ্র শেষ, ৩। গল্পে মধুসূদন, ৪। একটু গেলে বুনোপথ, ৫। রেখ মা দাসেরে মনে, ৬। রজনীগন্ধা বনে ঝড়, ৭। নিষিদ্ধ সৌরভ, ৮। বিনষ্ট সংলাপ, ৯। চির জনম হে, ১০। মাধুরী, ১১। শঙ্খচুড়,। ১২। শাওন, ১৩। নির্বাচিত গল্প (কলিকাতা), ১৪। তোমাকে ভালবেসে (কলিকাতা), ১৫। ডহুরী, ১৬।এস,এম, সুলতান সচল সবাক ইতিহাস, ১৭। এস,এম,সুলতান ঃ কর্ম ও জীবণ, ১৮। ব্রাত্যজন, (প্রথম উপন্যাস), ১৯। প্রান্তজন, ২০। মারিয়া, ২১। লোকজন, ২২। কপোতাক্ষী, ২৩। বালাখানার মেহমান- চলচ্চিত্রায়িত ( আল –মানার অডিও ভিজ্যুয়াল সেন্টার, মগবজার, ঢাকা)। ২৪। শেষকৃত্য, ২৫। সুন্দর বনের লোকজীবন, ২৬। সুন্দরবনের ক্ষুদ্র নৃ, ২৭। অযাচিত। তার সম্পাদিত পত্রিকা ঃ ক্ষণিক, স্মৃতি, আগন্তক, শিল্প-সাহিত্য, মেডিক্যাল জার্নল (কুষ্টিয়া)। সম্পাদিত গ্রন্থঃ শিল্পী রফিক হুসাইন বিরচিত -– বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের ইতিহাস।
অনুদিত গ্রন্থঃ (Slective novel of ABUL HOSSAUN JAHANGIR) এসব সাহিত্য রচনায় কৃতিত্বের জন্য তিনি বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কিৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন। লাভ করেছেন বেশ কিছু পুরস্কার ও সন্মাননা। ২০০৮ সালে রাজগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ তাকে সংবর্ধনা প্রদান করেন। সেখানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন তথকালীন শিক্ষামন্ত্রনালয়ে যুগ্ম সচিব নজরুল ইসলাম খান। একই বছর রাজগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় তাকে গণসংবর্ধনা প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি জনাব ডঃ আব্দুস সাত্তার। ২০০৯ সালে মধুসূদন পাবলিক লাইব্রেরী তাকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করেন যেখানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি ডঃ মোঃ আনোয়ারুল করিম। ১৬/০১/২০১০ সালে মণিরাপুর সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় চত্তরে বই মেলার অনুষ্ঠানে মনিরামপুর শিল্পী গোষ্ঠী তাকে সন্মাননা প্রদান করেন। সেখানে তাকে ক্রেষ্ট তুলে দিয়েছিলেন তৎকালিন মনিরামপুরের সংসদ সদস্য এ্যডঃ খান টিপু সুলতান। এছাড়া অনান্য পুরষ্কার ও সম্মননার মধ্যে রয়েছে, ব্র্যাক ট্রাস্ট কিশোরী ক্লাব মেবারকপুর, রংধনু সাহিত্য পুরস্কার ডুমুরিয়া- খুলনা, সুজন সম্মানানা মনিরামপুর, জীবনান্দ দাস সম্মাননা কলিকাতা, বঙ্গবন্ধু সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা, ঢাকা। ধান সিঁড়ি সম্মননা, ঢাকা।
এছাড়াও লেখক তার রাজগঞ্জের নিজ বাড়ীতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একটি ব্যাক্তিগত গ্রন্থাগার। সেখানে অসংখ্যা বই এবং পত্র পত্রিকা আছে। প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারী গ্রন্থাগারের সামনে বসে দিন ব্যাপী বই মেলা। অসংখ্যা বই প্রেমি সেদিন পাঠাগার প্রাঙ্গনে উপস্থিত হয়ে পরিচিত হন নিত্য নতুন বইয়ের সাথে। পাঠকেরা তা বিনামূল্যে পাঠ করেত পারেন। তিনি তার পাঠাগারের পাশেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন একটি মসজীদ সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে স্থানীয় মুসল্লীরা। এই গুনি কথা শিল্পীর সাথে প্রতিবেদকের কথা হলে তিনি বলেছিলেন, “ছোটবেলা থেকে লেখার ইচ্ছা থেকেই এই অবস্থান তিনি তৈরি করে ছিলেন । থামেনি না এই পথচলা যতদিন তিনি যতদিন সুস্থ ছিলেন। আশা করেছিলেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা পাওয়ার । গভীর শ্রদ্ধা সেই চিরবিদায়ী পিতা-মাতাকে যাদের জন্য এই পথ চলা, সকল পাঠক-পাঠিকা এবং সুভানুধ্যায়ীদের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা”। বহু প্রতিভার এই সাহিত্যিক চাকুরী থেকে অবসর গ্রহন করার পর অবসরের টাকা দিয়ে তার হুশতলা বকচরের বাড়িটি নতুন করে তৈরীর কাজে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম হটাৎ করে তিনি ষ্ট্রোকে আক্রান্ত হন। যশোর করোনারীকেয়ার ইউনিট পরে ঢাকা তার পর আবার যশোরে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। চিকিৎসার ফলে কিছুটা উন্নতি হলেও আবার তিনি স্বাভাবিক জীবনে হয়ত আগের মত আর ফিরতে পারলেননা। বকচরের বাড়িতে তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রী এবং ছেলে-বৌমাদের সাথে দিন কাটাচ্ছিলেন কিন্তু দিনকে দিন তিনি হারিয়ে ফেলছিলেন জীবনী শক্তি ।
অবশেষে গুনি এই সাহিত্যিক এবং চিকিৎসক সবাইকে কাদিয়ে আজ বুধবার সন্ধ্যা ৬ঃ৫ মিনিটে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।