পুরান ঢাকার আরমানীটোলায় শুক্রবার ভোরের আকাশ ভরে যায় ধোঁয়ায়। সেখানকার হাজী মুসা ম্যানশন নামে একটি ৬তলা ভবনে লাগা ভয়াবহ আগুনে মৃত্যু হয় চারজনের। আহত হন কমেপক্ষে ৫০ জন। আগুন, ধোঁয়া আর আর্তচিৎকারের এক বিভীষিকাময় ভোর দেখল আরমানীটোলা।
স্থানীয়রা বলেন, ভবনের বাসিন্দারা দাউ দাউ আগুনের পাশাপাশি তীব্র ধোঁয়া ও ক্যামিকেলের ঝাঁজের কারণে আটকা পড়েন। ভবনটির ছাদ বন্ধ থাকায় তারা ছাদেও যেতে পারেননি। বারান্দা থেকে সাহায্যের আশায় চিৎকার করতে থাকেন। তাদের বাঁচার আকুতি আর আর্তচিৎকারে এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন তাদের উদ্ধার করেন।
ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানিয়েছে, শুক্রবার ভোর ৩টা ১৮ মিনিটে হাজি মুসা ম্যানশন নামের ৬তলা ভবনের নিচ তলায় কেমিক্যালের গোডাউনে আগুনের সূত্রপাত হয়। সংবাদ পেয়ে আগুন নেভানো ও উদ্ধার কাজে অংশ নেয় ফায়ার সার্ভিসের সদরঘাট, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও ও সিদ্দিকবাজার সদর দপ্তরসহ ১৯টি ফায়ার ইউনিট। আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয় হেড কোয়ার্টারের লাইটিং ইউনিট, টিটিএল, ক্রাউট কন্ট্রোল ইউনিট, অ্যাম্বুলেন্স ইউনিট।
ফায়ার কর্মীরা আগুন নেভানোর পাশাপাশি ভবনে আটকা পড়ে আহত অবস্থায় ১৪ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। ওই ভবনের নিরাপত্তা কর্মীসহ তিনজনের লাশ উদ্ধার করে বডি ব্যাগে সংরক্ষণ করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মিটফোর্ড হাসপাতালে মারা যান। ভবনের ৩তলায় আটকে পাড়া একটি পোষা টিয়া পাখি উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে ফায়ার সার্ভিস।
আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলে যান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন, পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান, লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান, লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমানসহ কর্মকর্তারা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হাজী মুসা ম্যানসনের পাশে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এটিএম বুথের সিকিউরিটি গার্ড বজলুর রহমান জানান, এটিএম বুথের দরজা খুলে ভেতরে রেস্ট নিচ্ছিলাম। হঠাৎ শব্দ শুনে বাইরে বের হয়ে আগুন দেখি। মুসা ম্যানশনের সামনে গিয়ে দেখি, সারা ভবনে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ভবনে থাকা লোকজন তখন বাঁচার জন্য চিৎকার করছে। কেউ কেউ জানালার কাঁচ ভেঙে বা গ্রিল ভেঙে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। ভবনের নিচের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে একজনকে উদ্ধার করি। কিন্তু আগুনের তীব্রতা বেশি হওয়ায় আর ওপরে উঠতে না পেরে ভবনের দোতলা থেকে নিচে নেমে আসি।
বজলু বলেন, বেরিয়ে নিচ থেকে ওপরে তাকিয়ে দেখি ভবন থেকে নারী-পরুষ আগুন থেকে বাঁচার জন্য চিৎকার করছেন। অনেকে দোয়া-দরুদ পড়ছেন। তারা বিভিন্নভাবে জানালার কাঁচ ভেঙে লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আগুন লাগার ঠিক ১০ মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে আসে। তারা এসে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ক্যামিকেলের কারণে ভবনের ভেতরে প্রচুর ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। এই ধোঁয়া থেকে বাঁচতে ভেতরের লোকজন তখনও চিৎকার করছিল। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ভবনের গ্রিল কেটে প্রথমে শিশু ও নারীদের এবং পরে পুরুষদের উদ্ধার করে নিচে নামিয়ে আনে।
ভবনের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন জানান, আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। কিছু সময় পরই সেহরির জন্য উঠব। কিন্তু তার আগেই ভোর সোয়া ৩টার দিকে বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। এর মধ্যেই অনেকে আগুন আগুন বলে চিৎকার শুরু করে। আমি চারতলা থেকে ছাদে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ছাদ বন্ধ ছিল। পরে বারান্দায় দিয়ে গ্রিল ভাঙার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন গ্রিল কেটে আমাদের উদ্ধার করেন।
বংশাল থানার ওসি মো. শাহীন ফকির জানান, ভবনের ওপরের তলায় নিরাপত্তারক্ষীর কক্ষ থেকে দুটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের একজন ওয়ালিউল্লাহ ও আরেকজনের নাম কবির হোসেন। শুক্রবার সকাল ১১ টার দিকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে সকালে নিরাপত্তাকর্মী রাসেলের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। রাসেল নিরাপত্তা কর্মীর পাশাপাশি একটি দোকানে কর্মচারি হিসেবেও কাজ করত। কবীর হচ্ছেন ওলিউল্লাহর কাছে বেড়াতে আসা তার আত্মীয়। লাশগুলো যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এ ছাড়া ভবন থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ইডেন কলেজের ইংরজী বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সুমাইয়া আক্তারকে (২২)। তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
হাজী মুসা ম্যানশনে আগুনের ঘটনায় আহতদের চারজন ফায়ার সার্ভিস কর্মী। ফায়ার সার্ভিসের আহত কর্মীরা হলেন গিয়াসউদ্দিন (৪৫) বিসুপদ মিস্ত্রি (৪০), লিটন (৩০) ও ফরহাদ রহমান(৩৮)।
আহতদের বেশিরভাগ শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ও আগুনে পোড়া ছিল। তাদের কয়েকজনকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনিস্টিউট হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এদের মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী আশঙ্কাজনক অবস্থায় আইসিইউতে আছেন। বাকি ১৬ জন বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি। চিকিৎসাধীনদের মধ্যে মোস্তফা নামে একজন চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। ভর্তি ২০ জনের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এদের মধ্যে দুজনের ফিজিক্যাল বার্ন। দগ্ধদের কয়েক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
আহতরা হলেন আশিকুজ্জামান (৩৩), তার স্ত্রী ইসরাত জাহান মুনা (৩০), শ্বশুর ইব্রাহিম সরকার (৬০), শাশুড়ি সুফিয়া বেগম (৫০), শ্যালক জুনায়েদ (২০), মোস্তফা (৪০), ইউনুস মোল্লা (৬০), সাকিব হোসেন (৩০), সাখাওয়াত হোসেন (২৭), সাফায়েত হোসেন (৩৫), চাষমেরা বেগম (৩৩), দেলোয়ার হোসেন (৫৮), আয়সাপা (২), খোরশেদ আলম (৫০), লায়লা বেগম (৫৫), মোহাম্মদ ফারুক (৫৫), মেহেরুন্নেসা (৫০), মিলি (২২), পাবিহা (২৬),আকাশ (২২) ও আসমা সিদ্দিকা (৪৫)।
শুক্রবার দুপুর পৌনে ১২টায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক তন্ময় প্রকাশ ঘোষ এসব কথা জানান।
আগুনের ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। আগামী ১০ কার্যদিবসে প্রতিবেদন জমা দেবে এই কমিটি। সূত্র-দেশরূপান্তর।